ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওলায় মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান
হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনযায়ী,বনী হাশিমের বুদ্ধিমতী নারী হযরত যাইনাব বিনতে আলী ওয়া ফাতিমা (সা. আ.) র উপর লিখিত ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওলায় মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খানের লিখিত শীর্ষক প্রবন্ধটি নীচে তুলে ধরা হল:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
اَلسَّلَامُ عَلَیْکِ یَا عَقِیْلَةَ بَنِيْ هَاشِمٍ
হে বনী হাশিমের বুদ্ধিমতী নারী ( যাইনাব বিনতে আলী ওয়া ফাতিমা ) আপনার উপর সালাম !!
১৫ রজব কারবালার হুসাইনী কিয়াম , আন্দোলন ও বিপ্লবের বার্তাবাহিকা ( ইমাম হুসাইনের ভগ্নি) হযরত যাইনাব বিনতে আলীর ( আ) শাহাদাত সম রিহলাত ও ওফাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাই আন্তরিক শোক ও সান্ত্বনা ( তাসলিয়াৎ )। ইমাম হুসাইনের শাহাদাত , বিপ্লব ও কিয়াম কারবালায় সীমাবদ্ধ ও মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকত যদি হযরত ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যাইনুল আবেদীন ( আ) , হযরত যাইনাব বিনতে আলী ( আ) এবং আহলুল বাইতের (আ ) অন্য সকল সদস্য কারবালা - ই মুআল্লার প্রকৃত সত্য ও আসল ঘটনা উন্মোচন এবং জনসমক্ষে তা ব্যক্ত ও বর্ণনা না করতেন । কারবালায় আশুরার দিবসে ( ১০ মুহাররাম ৬১ হিজরী ) ইমাম হুসাইনের (আ) শাহাদাতের পর হযরত যাইনাব ( আ) যুগের ইমাম হযরত আলী ইবনুল হুসাইন যাইনুল আবেদীন ( আ) যিনি হযরত যাইনাবের ভ্রাতষ্পুত্র তাঁর দিকনির্দেশনায় আহলুল বাইতের ( আ ) নারী ও শিশুদের দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব নেন এবং তা সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন । এ ছাড়া তিনি ( হযরত যাইনাব ) অসুস্থ ইমাম যাইনুল আবেদীনের ( আ ) সেবা শুশ্রূষার ভারও নিয়েছিলেন এবং ইয়াযীদের সেনাবাহিনী ও সমর্থকদের অনিষ্ট সাধন ও হত্যার উদ্যোগ থেকে ইমাম যাইনুল আবেদীনকে (আ ) নিরাপদ রাখার জন্য নিজের জীবনকেও বারবার বিপদগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ করেছিলেন । হযরত যাইনাব ( আ) ছিলেন আসলেই পিতার শোভা ও সৌন্দর্য । করণ যাইনাব শব্দের অর্থ যাইনুল আব অর্থাৎ যীনাতুল আব ( পিতার সৌন্দর্য ও শোভা ) । তিনি ছিলেন হযরত রাসূলুল্লাহর (সা) জৈষ্ঠ্যা দৌহিত্রী ( নাত্নী ) । হযরত আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী ( আ) এবং খাতূনে জান্নাত জগৎ সমূহের নারীদের নেত্রী হযরত ফাতিমা ( আ) বিনতে রাসূলুল্লাহর (সা) জৈষ্ঠ্যা কন্যা সন্তান এবং বেহেশতের যুবকদের নেতৃদ্বয় ইমাম হাসান ( আ) ও ইমাম হুসাইনের ( আ) ভগ্নি । হযরত যাইনাব (সা. আ.) আহলুল বাইতের (আ) পাক পবিত্র পাঁচ জনের ( হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) , হযরত আলী , হযরত ফাতিমা এবং ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ) হাতে প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে পাঁচটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য অর্জন ও লাভ করেছিলেন যা থেকে হযরত যাইনাবের ( সা. আ.) সুমহান ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট হয়ে যায় ।
১ম বৈশিষ্ট্য ( জ্ঞান , পরিচিতি , বুদ্ধিমত্তা ,অনুধাবন ও উপলব্ধির ক্ষমতা ) :
হযরত যাইনাব ( সা. আ. ) তাঁর প্রথম শিক্ষক হযরত রাসূলুল্লাহর ( সা ) কাছ থেকে ইলম ( জ্ঞান ) , মারিফাত ( পরিচিতি ) , আকল ( বুদ্ধিমত্তা ) ও দিরায়ত ( উপলব্ধি ও অনুধাবন ক্ষমতা ) অর্জন করেন । হযরত যাইনাব ছিলেন ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় পারদর্শী । তিনি ছিলেন পবিত্র কুরআনের মুফাসসির । তাই হযরত ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ ) স্বীয় ফুফী যাইনাব বিনতে আলীকে ( আ ) আলিমাতুন গাইরু মুআল্লামাহ ( কোনো শিক্ষকের কাছে পাঠ ও শিক্ষা নেওয়া ছাড়াই বিদুষী নারী ) বলে অভিহিত করেছিলেন । অসাধারণ জ্ঞান , পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিমত্তার জন্য হযরত যাইনাবকে (সা. আ.) আকীলাতু বনী হাশিম ( অর্থাৎ বনী হাশিমের বুদ্ধিমতী নারী ) বলা হত ।
২য় বৈশিষ্ট্য ( সাহস ) :
২য় শিক্ষক পিতা শেরে খোদা আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলীর (আ) কাছ থেকে তিনি ( যাইনাব ) অর্জন করেছিলেন অসাধারণ সাহস ও সাহসিকতা ( শাজাআত ) । ইমাম হুসাইনের (আ ) শাহাদাতের পর হযরত যাইনাব (সা. আ.) আহলুল বাইতের (আ) কাফিলার নারী ও শিশুদের দায়িত্ব নেন এবং তাদেরকে হিংস্র পাষণ্ড নর পিশাচ ইয়াযীদীদের অনিষ্ট সাধন ও ক্ষতি থেকে ঢালের মতো রক্ষা করেন ।কারবালা থেকে কূফায় , কূফায় ইবনে যিয়াদের দরবারে , কূফা থেকে দামেশকে এবং দামেশকে ইয়াযীদের দরবারে হযরত যাইনাব ( আ) অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং আহলুল বাইতের সঠিক পরিচিতি , গৌরব ও ফযীলত বর্ণনা করেছিলেন এবং ইয়াযীদ , মুআবিয়া , ইবনে যিয়াদ ও বনী উমাইয়ার অপকীর্তি ও জঘন্য কালো কুৎসিত ভয়ঙ্কর চেহারা উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন । ইয়াযীদের হাতে নির্মমভাবে মযলূম ইমাম হুসাইন ( আ ) ও তাঁর সংগীসাথীদের শাহাদাত বরণের প্রকৃত কাহিনী সবার সামনে সাহসিকতার সাথে নির্ভীকভাবে ব্যক্ত করেছিলেন হযরত যাইনাব (আ) ।
পাপিষ্ঠ নরাধম উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ কূফার দারুল ইমারায় ( গভর্নর ভবনে ) ইমাম হুসাইনের (আ) কর্তিত মাথা রাখা হলে হযরত যাইনাবকে ( সা. আ.) কটাক্ষ করে বলেছিল : " খোদার সকল প্রশংসা যিনি তোমাদেরকে ( মহানবীর পবিত্র আহলুল বাইত - আ -) অপদস্থ ও ধ্বংস করেছেন এবং তোমাদের মিথ্যাবাদিতাকে ফাঁস করে দিয়েছেন ! " তখন হযরত যাইনাব (আ) এর জবাবে বলেছিলেন : " যারা ফাসেক - লম্পট তারাই অপদস্থ হয় ; লম্পট লোকেরাই মিথ্যা কথা বলে । আর আমরা ফাসেক - ফাজের বা লম্পট নই ।
সহস্র প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি মুহাম্মদ ( সা) দ্বারা আমাদের কে সম্মানিত করেছেন এবং আমাদেরকে পবিত্রতার মর্যাদা দিয়েছেন । তুই যেরূপ বলেছিস সেই রূপ নয় । পাপী সর্বাবস্থায়ই হীন লাঞ্ছিত । পাপীর নামেই কলঙ্কের ছাপ পড়ে থাকে ।"
" ইবনে যিয়াদ তখন তাঁকে বলেছিল : " খোদা তোমার ভাইয়ের ( হুসাইন ) সাথে যে আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে তোমার কী অভিমত ? " । হযরত যাইনাব (সা. আ.) প্রত্যুত্তরে বললেন :
مَا رَأَیْتُ إِلَّا جَمِیْلَاً ، هٰؤُلَاءِ قَوْمٌ کَتَبَ اللّٰهُ عَلَیْهِمُ الْقَتْلَ فَبَرَزُوْا إِلَیٰ مَضَاجِعِهِمْ.
" আমি সুন্দর ও সৌন্দর্য্য ছাড়া আর কিছুই প্রত্যক্ষ করি নি । এঁরা ( হুসাইন ও তাঁর সংগী সাথীগণ ) ছিলেন এমন এক গোষ্ঠী যাদের উপর মহান আল্লাহ শাহাদাত অবধারিত ও নির্ধারিত ( ফরয ) করে দিয়েছিলেন ; তাই তাঁরা তাঁদের বধ্যভূমি ও শাহাদত স্থলের দিকে ( কারবালা ) পৌঁছে গিয়েছেন ( এবং শাহাদাত বরণ করেছেন ) । সত্বরই আল্লাহ তাদের সাথে তোমাকেও একত্রিত করবেন । তখন তোমরা পরস্পর আল্লাহর দরবারেই এই ব্যাপারে বোঝাপড়া করতে পারবে । "
আসলে কত বড় সাহস ও ধৈর্য্যের অধিকারী না হলে ঐ তীব্র সংকটজনক পরিস্থিতিতে এ ধরণের কথা বলা আদৌ সম্ভব ?!!
৩য় গুণ বা বৈশিষ্ট্য :
সতীত্ব , শালীনতা , লজ্জা ও হিজাব ( পর্দানশীনতা অর্থাৎ ইফ্ফাৎ ও হিজাব ) : হযরত যাইনাব (আ) এ বৈশিষ্ট্য তাঁর ৩য় শিক্ষয়ত্রী স্বীয় মাতা হযরত ফাতিমা যাহরার (আ) কাছ থেকে অর্জন করেছিলেন । হযরত আমীরুল মুমিনীন আলীর (আ) এক প্রতিবেশী বলেছেন : আমি ৭ বছর হযরত আমীরুল মুমিনীন আলীর (আ) পরিবারের প্রতিবেশী ছিলাম ।
আমি কোনোদিন হযরত যাইনাব কে ( আ) দেখি নাই এবং তার কণ্ঠস্বরও শুনি নাই এই ৭ বছরে !
৪র্থ গুণ ও বৈশিষ্ট্য :
ধৈর্য্য ( সবর ) : হযরত যাইনাব (আ) এ বৈশিষ্ট্যটি তার চতুর্থ শিক্ষক জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা আবূ মুহাম্মদ ইমাম মুজতাবা হাসান ইবনে আলীর ( আ) কাছ থেকে শিখেছিলেন ও আয়ত্ত্ব করেছিলেন । তাই আমরা আশুরার দিবসে ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের পর কারবালার ময়দানে , কূফায় যাওয়ার পথে , ইবনে যিয়াদের দরবারে , কূফা থেকে শামে যাওয়ার পথে , শামের বাজারে এবং পাপীষ্ঠ নরপশু ইয়াজিদের দরবারে হযরত যাইনাবকে ( আ) ধৈর্য্য ও সবরের মূর্ত্য প্রতীক হিসেবে আহলুল বাইতের (আ) ওপর আপতিত বালা ও মুসিবত সমূহে দেখতে পাই । আপতিত এ সব বালা মুসিবতের জন্য হযরত যাইনাব ( আ) উম্মুল মাসায়েব ( বালা মুসিবতের মা ) বলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন । তাই খোদা তোমার ভাইয়ের ( হুসাইন ) সাথে যে আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে তোমার কী অভিমত ? " নরপশু ইবনে যিয়াদের এ প্রশ্নের জবাবে হযরত যাইনাব (আ:) পূর্ণ আত্ম প্রত্যয় সহকারে বেলেছিলেন :
" আমি সুন্দর ও সৌন্দর্য্য ছাড়া আর কিছুই প্রত্যক্ষ করি নি । এঁরা ( হুসাইন ও তাঁর সংগী সাথীগণ ) ছিলেন এমন এক গোষ্ঠী যাদের উপর মহান আল্লাহ শাহাদাত অবধারিত ও নির্ধারিত ( ফরয ) করে দিয়েছিলেন ; তাই তাঁরা তাঁদের বধ্যভূমি ও শাহাদত স্থলের দিকে ( কারবালা ) পৌঁছে গিয়েছেন ( এবং শাহাদাত বরণ করেছেন ) ।
সত্বরই আল্লাহ তাদের সাথে তোমাকেও একত্রিত করবেন । তখন তোমরা পরস্পর আল্লাহর দরবারেই এই ব্যাপারে বোঝাপড়া করতে পারবে । "
৫ম গুণ বা বৈশিষ্ট্য :
আত্ম মর্যাদা বোধ ( ইযযাতুন্ নাফ্স্ ) : এ গুণটি হযরত যাইনাব (আ) ৫ম শিক্ষক স্বীয় ভ্রাতা ইমাম হুসাইনের ( আ) কাছ থেকে শিক্ষা ও অর্জন করেছিলেন । ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে এবং বাতিল যালিম ইয়াযীদের আনুগত্য প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে ইমাম হুসাইন ( আ) সবাইকে আদর্শ ও আত্মমর্য্যাদা বোধের শিক্ষা ও অনুশীলন দিয়েছিলেন কারবালায় । আর এ কারণেই আমরা দেখতে পাই হযরত যাইনাব (আ) কারবালায় ইমাম হুসাইনের (আ) শাহাদাতের পর হুসাইনী আন্দোলন ও আদর্শের পতাকা স্বীয় যুগের ইমাম হযরত যাইনুল আবেদীনের নির্দেশে দৃঢ় ভাবে ধারণ এবং সর্বত্র ইসলাম , পবিত্র কুরআন ও মহানবীর (সা) আহলুল বাইতের (আ) পক্ষে কথা বলেছেন । শাম থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর তিনি চুপচাপ বসে থাকেন নি । বরং সবসময় তিনি বনী উমাইয়া বিশেষ করে পাপীষ্ঠ ইয়াযীদের খিলাফত ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতেন যা থেকে ইয়াযীদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা জন্য অত্যন্ত ভীত ও শঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল । ইয়াযীদের নির্দেশে তাঁকে ( আ ) মদীনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল । তিনি কারবালায় ইমাম হুসাইনের (আ) শাহাদাতের ১ বছর ছয় মাস পর ১৫ রজব দামেশকে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন । এই সাহসী অকুতোভয় বীর রমণী কারবালার ময়দানে নিজের দুই পুত্র আওন ও জাফারকেও ইমাম হুসাইনের (আ) পথে উৎসর্গ করেছিলেন ।
মহান আল্লাহ পূণ্যবতী এ নারীকে
আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ করে দিন ।
মহান আল্লাহর সালাম আমীরুল মুমিনীন আলী ( আ) এবং হযরত ফাতিমার (আ) জৈষ্ঠ্যা কন্যা সন্তান হযরত যাইনাবের ওপর বর্ষিত হোক ।